বদলি হলেন হবিগঞ্জের ডিসি ইশরাত জাহান,শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় বিদায় নিলেন

আপামর জনসাধারণ, প্রশাসনের সব শ্রেণীর কর্মকর্তা কর্মচারীবৃন্দ ও সাংবাদিকদের শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় বিদায় নিলেন হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ডিসি ইশরাত জাহান। প্রায় ২ বছরের অধিক কর্মরত থেকে চাকুরি নিয়মানুযায়ী তিনি বদলি হলেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের উপ-সচিব হিসেবে। বদলি হওয়ার আগ মূহূর্ত পর্যন্ত তিনি ছিলেন- হবিগঞ্জবাসির কাছে একজন নিবেদিত প্রাণ।
একজন দক্ষ প্রশাসক। হবিগঞ্জে যোগদানের পর থেকেই এলাকার মানুষকে খুব আপন করে নিয়েছিলেন। তার কর্মদক্ষতা, সততা ও ন্যায় নিষ্ঠতায় জেলার আবাল বৃদ্ধ বনিতাসহ সব পেশাজীবী মানুষের মনি কোঠায় স্থান করে নিয়েছিলেন তিনি। তিনি এলাকার উন্নয়নে ও নতুনত্ব আনয়নে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছেন। সর্বদা সচেষ্ট থেকেছেন হবিগঞ্জবাসীর খেদমতে। জেলার সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি হয়েও তিনি মানুষের সাথে মিশেছেন সহজ স্বাভাবিকভাবে। তিনি মনযোগ সহকারে শুনেছেন জেলার সাধারণ মানুষের কথা। চেষ্টা করেছেন তাৎক্ষণিকভাবে তা সামাধানেরও। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ছিলো তার কর্মব্যস্ততা। শুধু মানুষের সমস্যা সামাধানেই নয় জেলার উন্নয়নেও তিনি ছিলেন সচেষ্ট। সরকারের প্রতিটি বরাদ্দ ও প্রকল্প তিনি নিজে নজরদারি করে তা যথাযথ বাস্তবায়নেরও ব্যবস্থা করেছেন। মাঠ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ হচ্ছে জেলা প্রশাসক (ডিসি)।
ডিসি জেলার শীর্ষপদ। সরকারের উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়। হবিগঞ্জে জেলা প্রশাসক পদে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করছেন ইশরাত জাহান। অত্যন্ত দক্ষতার সাথে জেলা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করে ইতিমধ্যে প্রশংসিত হয়েছেন তিনি। গত ২০২১ সালের ২৮ জানুয়ারী হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসক হিসাবে যোগদানের পর কৃতিত্বের সঙ্গে ২৯ মাস পূর্ণ করেছেন। বাংলাদেশের প্রশাসনিক ক্যাডারে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার একটি স্টেশনে ২৯ মাস অবস্থান করা অত্যন্ত কঠিন ও দুরুহ একটি বিষয়। কিন্তু এ অসম্ভবকে জয় করেছেন ইশরাত জাহান। যশোর জেলার কন্যা ইশরাত জাহান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রী ছিলেন। বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ২২তম ব্যাচের কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি জীবনে তিনি খুলনা পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, মাদারীপুর সদর উপজেলার ইউএনও, খুলনা জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি হবিগঞ্জে বদলি হয়ে আসার পূর্ব পর্যন্ত ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন ২) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে ইশরাত জাহান তৃতীয়। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই সন্তানের জননী। তার স্বামী শরিফুল ইসলামও মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার পিতা মো. শামসুর রহমান ছিলেন সরকারি চাকুরীজীবী এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা। ইশরাত জাহান ব্যক্তি জীবনে তার পিতার মত বিনয়ী ও সাদা মনের মানুষ। সততা, আদর্শ এবং নিষ্ঠার সাথে নিরলসভাবে তিনি সরকারি দায়িত্ব পালন করেছেন। সাধারণ মানুষের প্রতি রয়েছে তাঁর অগাধ দরদ ও ভালবাসা। অবিচল আস্থা হৃদয়ের সেতুবন্ধন নিজ দপ্তরের কাজকে জীবনের চেয়েও আপন মনে করেন তিনি। দেশ ও জাতির যোগ্য সন্তানের মানসে দেশকে এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয়ে বলিয়ান এক কর্মবীর ইশরাত জাহান। হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালনে তার সফলতার চিত্র বিভিন্ন মিডিয়ার কর্মীরা জাতির সামনে তুলে ধরেছেন। যে সমস্ত কাজে তিনি বিচক্ষণতার সাথে সহায়তা প্রদান করেছেন সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: হবিগঞ্জ পৌরবাসীর দীর্ঘদিনের গলারকাটা বাইপাস সড়কের পাশ থেকে ময়লার ভাগাড় অপসারণ করেছেন। পুরাতন খোয়াই নদীর পাড়ে ওয়াকওয়ে নির্মাণ, সাধারণ রোগীদের জন্য জেলা সদর আধুনিক হাসপাতালে ১০টি কেবিন স্থাপন, শিশুদের সাঁতার শিখানোর জন্য শিল্পকলায় সুইমিংপুল স্থাপনসহ উল্লেখ্য যোগ্য কাজ করেছেন। তাছাড়া জেলার প্রতিটি উপজেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বীর নিবাস নির্মাণেও রেখেছেন ভূমিকা। সর্বশেষ শিশুদের বিনোদন কেন্দ্র স্থাপনে উদ্যোগ গ্রহন করেন। ইতিমধ্যে মাধবপুরে হবিগঞ্জ শিশু পার্ক নির্মাণ করেছেন শহরতলীর ধুলিয়াখালের বিসিক শিল্পনগরী এলাকায় শিশু পার্ক নির্মাণের কাজ। শান্তিপূর্ণভাবে পৌরসভা এবং উপজেলা পরিষদ নির্বাচন পরিচালনা ছাড়াও একনিষ্ঠভাবে সরকারের নীতি, আদর্শ ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন। জেলা পর্যায়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসসমূহ ও অনুষ্ঠানাদি যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপন। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার কাজে প্রাণান্তকরভাবে ই-ফাইলিং, ই-মোবাইল কোর্ট, ই-মিউটেশন ও অনলাইনভিত্তিক সেবা কার্যক্রম হবিগঞ্জে চালু করা। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও সার্কিট হাউসের দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য বর্ধন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বিজড়িত স্থান সংরক্ষণ। সরকারি স্কুলের সামনে জাতির পিতা ও বঙ্গমাতার ম্যুরাল স্থাপন। প্রতিদিন গণশুনানির মাধ্যমে মানুষের বহুবিধ সমস্যার সমাধান লাঘবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী পালনের জন্য বছরব্যাপী ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ যা করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে কিছুটা বিঘ্নিত হয়েছে।
কোভিড-১৯ মহামারি করোনা ভাইরাস প্রতিরোধ ও মোকাবেলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে হবিগঞ্জে প্রতিনিধি হিসেবে সফলতার সাথে অনলাইন ব্রিফিংমাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন ।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর খাদ্য উপহার সামগ্রী হতদরিদ্র মানুষদের মাঝে বিতরণ করছেন। জেলার জাতীয় সংসদ সদস্য, বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি ও নেতৃবৃন্দসহ আপামর জনসাধারণের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করে হবিগঞ্জ জেলাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। সদ্য গত ৯ জুলাই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের উপ-সচিব হিসেবে বদলী করা হয়। এরপর ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হবিগঞ্জের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও নিজ এলাকার লোকজন এবং আত্মীয় স্বজনসহ সূধীজন বন্ধুজন তার অতীতের কর্মকান্ড নিয়ে গুনকীর্তন করেন। করোনা মহামারির শুরু থেকে তিনি ছুটেছেন সচেতনতার বার্তা নিয়ে। দরিদ্র ও অভাবি মানুষের জন্য বাড়িয়েছেন সহায়তার হাত। শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, এতিম, দুঃখী, মেধাবী শিক্ষার্থীদের প্রতি ছিল তার সুদৃষ্টি, তাদের মুখে ফুটিয়েছেন হাসি। শিশু-কিশোর থেকে তরুণ-তরুণী, যুব-যুবাদের তিনি ভালো কাজে যেমন উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাই তিনি তরুণদের কাছে অনুপ্রেরণা ও আশীর্বাদ। ইশরাত জাহানের পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা শামসুর রহমান। তিনি ১৯৬৮ সালে চুনারুঘাট সার্কেল অফিসার (সিও ডেভেলপমেন্ট) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। চুনারুঘাটে সততা ও নিষ্ঠার সাথে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন তিনি। কর্মজীবনে তিনিও বিভিন্ন পদে গুরুতপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন। ইশরাত জাহান তার পিতার নীতি আদর্শকে অনুস্মরণ করে জেলার সার্বিক উন্নয়নে কাজ করছেন। জনসাধারণকে সেবা দিতে গিয়ে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন এই জেলা প্রশাসক। জনবান্ধব প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালনে সুনাম অর্জন করেছেন তিনি। জেলাবাসীর উন্নয়নে তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সাহসের সঙ্গে কাজ করে গেছেন এজন্য হবিগঞ্জবাসী সবসময় তাকে মনে রাখবে। ১৭ জুলাই অফিসার্স ক্লাব, পুলিশ সুপার, পৌরসভা, চেয়ারম্যান সংগঠন ও প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকেও বিদায়ী শুভেচ্ছা জানানো হয়। অফিসার্সক্লাবে এক বেদনা বিধুর পরিবেশে ডিসি ইশরাত জাহানকে বিদায়ী শুভেচ্ছা জানানো হয়। বিদায় সংবর্ধনা প্রদান অনুষ্ঠানে একের পর এক হবিগঞ্জ জেলার মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন তিনি। ২১ জুলাই ছিল হবিগঞ্জে কর্মস্থলের শেষ দিন। পরে হবিগঞ্জের নবাগত জেলা প্রশাসক দেবী চন্দ বিদায়ী জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহানের কাছ থেকে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
বিদায়ী জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান বলেন, হবিগঞ্জ জেলায় দীর্ঘদিন কর্মকাল শেষে জেলা প্রশাসকের দায়িত্বভার অর্পণ করে এই জেলা থেকে বিদায় নিচ্ছি। আমি শ্রদ্ধা জানাই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি। সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা জানাই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর প্রতি। শ্রদ্ধা জানাই বীর মুক্তিযোদ্ধাগণের প্রতি। জেলার সব সাংসদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। শ্রদ্ধেয় বিভাগীয় কমিশনারসহ সকল সিনিয়র স্যার ও জেলা প্রশাসন, হবিগঞ্জ টিমের সকল স্নেহাষ্পদ সহকর্মীদের প্রতি আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। সব জনপ্রতিনিধি, বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাবৃন্দ, শিক্ষক ও সাংবাদিকবৃন্দ, সুশীল সমাজের সদস্যবৃন্দসহ সকল স্তরের জনগণের প্রতি আমার সালাম ও শুভেচ্ছা। আমার এই কর্মকালে আমার সঙ্গে যারা কাজ করেছেন, সহযোগিতা করেছেন তাদের সবাইতে আমি আমার হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে ধন্যবাদ জানাই। নবাগত জেলা প্রশাসকের প্রতি সকলের সহযোগিতা একান্তই কাম্য। আমার ভুল ত্রুটির জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী এবং আমার ও আমার পরিবারের জন্য দোয়া প্রার্থী।’
নারীনেত্রী শেখ লাইজু বলেন, ‘এমন মানবিক গুণসম্পন্ন ডিসির কথা ভোলা যায় না। তার সততা, কর্মনিষ্ঠা, মানবিকতায় আমি মুগ্ধ। তার মত ডিসি যদি প্রতিটি জেলায় থাকতো তাহলে মানুষ অতি সহজে সেবা পেত।’