শিরোনাম

South east bank ad

নির্বাচন : একই প্রত্যাশায় জনতা ও সেনাবাহিনী

 প্রকাশ: ০৮ নভেম্বর ২০২৫, ০৮:৫৯ পূর্বাহ্ন   |   সেনাবাহিনী

নির্বাচন : একই প্রত্যাশায় জনতা ও সেনাবাহিনী

মোস্তফা কামাল


তিন বাহিনীর প্রধানরা রওনা করলেন প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার দিকে। গন্তব্যে পৌঁছতে যতটা দেরি গুজব রটাতে ততটা দেরি হলো না। প্রধান উপদেষ্টার আর রক্ষা নেই। আজই এসপার-ওসপার হয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু মিনিট কয়েকের মধ্যেই কিচ্ছার ফানুস শেষ। গুজববাজদের সুবিধা হলো না। সাধারণ মানুষ গ্রাহ্য করেনি সোশ্যাল মিডিয়ার খবর। আজগুবি কনটেন্ট না দেখে মূল ধারার গণমাধ্যমের দিকে অপেক্ষা করতে থাকে তারা।

অল্প সময়ের ব্যবধানে জানতে পারে, ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবসের আয়োজনে প্রধান উপদেষ্টাকে আমন্ত্রণ জানাতে গেছেন তিন বাহিনীর প্রধানরা। তিন বাহিনীর প্রধানদের সাক্ষাতে নির্বাচন প্রস্তুতি নিয়েই বেশি আলোচনা হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার।
আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অনুষ্ঠেয় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন করতে এবং নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বজায় রাখতে সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে তাঁদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। আবারও মনে করিয়ে দিয়েছেন, ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর নির্বাচনের ব্যাপারে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিশ্রুতির কথা।

সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান, বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষািটর প্রতি মানুষের ছিল ব্যাপক আগ্রহ। বাস্তবতা বুঝেছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং। সংবাদটি জানাতে দেরি করেনি। বৈঠকে জাতীয় নিরাপত্তার পাশাপাশি দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সামরিক বাহিনীর সদস্যদের কঠোর পরিশ্রমের জন্য সাধুবাদ জানান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, গত ১৫ মাসে সেনাবাহিনীসহ সব বাহিনীর সদস্যরা দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করেছেন।


বৈঠকে নির্বাচনের জন্য সামরিক বাহিনী সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়ার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করেছেন তিন বাহিনীর প্রধানরা। নির্বাচন ঘিরে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় ৯০ হাজার সেনা সদস্য, নৌবাহিনীর আড়াই হাজার সদস্য এবং বিমানবাহিনীর দেড় হাজার সদস্য মোতায়েন, প্রতিটি উপজেলায় এক কম্পানি সেনা মোতায়েনসহ আনুষঙ্গিক তথ্যও জানা হলো। এর মাঝেই নির্বাচন হলে দেশে স্থিতিশীলতা আরো ভালো বলে আশাবাদের কথা জানিয়েছে সেনাবাহিনী। সেটাও কোনো খুচরা আলাপে নয়, একদম আনুষ্ঠানিক ব্রিফ করে জানিয়েছে সেনা সদর। ঢাকা সেনানিবাসের অফিসার্স মেসে সেনা সদর আয়োজিত ব্রিফিংয়ে সফট টকে লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ারে লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. মাইনুর রহমান সোজা বাংলায় জানিয়েছেন, দেশের জনগণের মতো সেনাবাহিনীও চায় অন্তর্বর্তী সরকারের রূপরেখা অনুযায়ী একটা অবাধ, সুষ্ঠু এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। সেনাবাহিনী প্রত্যাশা করে, নির্বাচন হলে দেশের স্থিতিশীলতা আরো ভালো হবে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হবে এবং সেনাবাহিনী তখন সেনানিবাসে ফিরে যেতে পারবে।

তিনি সেনা সদর দপ্তরের আর্মি ট্রেনিং অ্যান্ড ডকট্রিন কমান্ডের (আর্টডক) জিওসি। ব্রিফিংয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল দেওয়ান মোহাম্মদ মনজুর হোসেন ও মোস্তাফিজুর রহমানও কয়েকটি প্রশ্নের জবাব পরিষ্কার করেন স্পষ্টভাষায়। বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তায় সেনাবাহিনীর কার্যক্রম তাঁরা ব্যাখ্যা করেন চমৎকারভাবে। কোন প্রেক্ষাপটে সেনাবাহিনী গত সোয়া এক বছর ধরে বেসামরিক প্রশাসনকে কত চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করছে, প্রতিকূল পরিস্থিতি মাড়াচ্ছে—তা উঠে আসে তাঁদের ব্রিফিংয়ে। লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাইনুর রহমান জানান, সরকার এখন পর্যন্ত নির্বাচনের যেটুকু রূপরেখা প্রণয়ন করেছে, সেটার ওপর ভিত্তি করে সেনাবাহিনী যথাযথ প্রস্তুতি নিয়েছে। কিছু স্বার্থান্বেষী মহল সেনাবাহিনী, বিশেষ করে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে মিথ্যা, বানোয়াট, উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচার চালাচ্ছে, এ বিষয় এড়িয়ে যাওয়া হয়নি। বরং নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করা হয়েছে। নিশ্চিত করা হয়েছে, সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্য সেনাবাহিনী প্রধান, সেনাবাহিনীর সিনিয়র লিডারশিপে শতভাগ অনুগত এবং বিশ্বস্ত। আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় সেনাবাহিনী এখন আরো বেশি ঐক্যবদ্ধ, তাদের ভ্রাতৃত্ববোধ এখন আরো বেশি—এ দাবিও করা হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার অপপ্রচার রুখতে যে মিথ্যা দিয়ে মিথ্যা ঢাকতে নেই, তা একটু ভিন্ন ন্যারেটিভে জানানো হয়েছে ব্রিফিংয়ে। লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাইনুর রহমানের ভাষায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রচারণার (নেতিবাচক) বিরুদ্ধে কিছু করার প্রয়োজন নেই। মিথ্যাকে বিতাড়িত করতে সত্যই যথেষ্ট। সত্যের মাধ্যমে এবং কাজের মাধ্যমে সেটার প্রমাণ করতে চায় সেনাবাহিনী।

ব্রিফিংয়ে প্রাসঙ্গিক আরো নানা বিষয়ই উঠে এসেছে। সময়ের চাহিদায় বেশি প্রাসঙ্গিক হচ্ছে নির্বাচন। রাজনৈতিক দল, প্রার্থী, ভোটারসহ দেশে-প্রবাসে সবাই নির্বাচনমুখী। সেনাবাহিনী জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার সেই অভ্যুত্থানের পর থেকেই যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে আসছে। সেই তাগিদ এবং চেষ্টায় তারা আরো বলীয়ান। কিন্তু খেয়াল করার বিষয়, সেখানে দুষ্ট চোখের চাহনি আঁচ করা যাচ্ছে। নির্বাচন বিঘ্নিত করতে সশস্ত্র বাহিনীকে চটাতে, মন ভাঙতে সর্বোপরি মনোবল দুর্বল করার জন্য কিছু নাটিগুটি চালানো হচ্ছে। নির্বাচন একটি উপলক্ষ মাত্র। চক্রটির চাহিদা হচ্ছে, দেশে-বিদেশে  সেনাবাহিনীর ইমেজ-সুনাম ও বিশ্ব মর্যাদায় আঁচড় বসানো। সেনাবাহিনী যত চেষ্টা-সাধনায় এ ইমেজকে আরো শাণিত করছে, কখনো কখনো তার চেয়েও বেশি চেষ্টা হচ্ছে ইমেজে ঘা লাগানোর। নির্বাচনী ট্রেন ট্র্যাকে উঠে পড়ায় মহলটি একটু মনোকষ্টে ভুগছে। পর পর তিনটি তামাশাপূর্ণ নির্বাচনের পর জনগণ মূলত মুখিয়ে আছে সেনাবাহিনীর দিকে। এটি আস্থা ও ভরসার বিষয়। বাংলাদেশের মতো দুর্যোগ-দুর্বিপাকসহ জাতীয় নানা প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর ওপর ভরসা করার দৃষ্টান্ত বিশ্বে কম দেশেই আছে। আবার সেনাবাহিনী নিয়ে অবান্তর কথা, আজেবাজে ন্যারেটিভ তৈরির প্রবণতাও বিশ্বে বিরল। চব্বিশের জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর এই রোগটি সেরে যেতে পারত। কিন্তু মাঝেমধ্যেই রোগ চাগাড় দেওয়ার লক্ষণ ভর করছে। সেই সঙ্গে আচানক-আজগুবি, রাতের ঘুম নষ্ট করা গুজবের হাট। সেদিন তিন বাহিনীর প্রধানের যমুনায় যাওয়া নিয়ে তা জমানো যায়নি। তার পরও সেনা সদরের ব্রিফিংটি কাজে দিয়েছে। অনেক কিছু পরিষ্কার করা হয়েছে। টুইস্ট করার মতো মেটেরিয়াল মেলেনি। তাই বলে তারা দমে গেছে বা দমে যাবে, সেই আশা করা বোকামি। বড়জোর একটু দম নেবে। দুই দিন পর আবার নামবে। প্রয়োজনে ফ্যাসিজম ডাকবে। তবু তাদের সেনাবাহিনীকে ডিস্টার্ব করা চাই।

চব্বিশের পটপরিবর্তনে সেনাবাহিনীর জনসম্পৃক্ততার অনন্য দৃষ্টান্তের প্রশংসা এ চক্রের চরম অসহ্য। নির্বাচন সামনে রেখে যেকোনো ছুতায় এর একটা প্রতিশোধ তাদের প্রত্যাশা। নির্বাচনের মুখ্য দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের হলেও তা কেবল তাদের একার নয়। এখানে প্রার্থী, ভোটার, রাজনৈতিক দল, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীসহ অংশীজন অনেক। ইসি অনেকটা রেফারির মতো। আর আম্পায়ারিংয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী বলতে মানুষ আগে চেনে পুলিশকে। তারপর সশস্ত্র বাহিনী,  র‌্যাব, বিজিবি, আনসার। বাস্তবতা হচ্ছে, পুলিশ এখনো ট্রমাগ্রস্ত। গেল সরকার আমলে নানা ক্রিয়াকর্মে পুলিশ হয়ে যায় জনতার প্রতিপক্ষ। ঘৃণার ওই জায়গা থেকে পুলিশ এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এর বিপরীতে সেনাবাহিনী চলে এসেছে আরো ভরসা ও আস্থার জায়গায়। গেল সরকার নির্বাচনকালীন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞা থেকেই তাদের খারিজ করে দিয়েছিল। এবার আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে নির্বাচন কমিশন ‘গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২’ সংশোধন করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে আবারও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। 

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা আর প্রয়োগকারীর মধ্যে বেশ ফারাক আছে। ভোট দেওয়া ভুলে যাওয়া মানুষের বিশ্বাস, নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে দায়িত্ব পালনে সুফল আসবে। এই বিশ্বাস থেকেই ২০০১ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আরপিও সংশোধন করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগগুলো বা সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। কেবল জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই নয়, পরবর্তী সময়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইনেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার ওই সংশোধনী অধ্যাদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞা থেকে প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগগুলো বাদ দেয়। এবার সেখানে আশাবাদের খবর। মানুষ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবে এ আশা ও নিশ্চয়তা গণতন্ত্রকামী যে কারোর জন্যই অত্যন্ত কাঙ্ক্ষিত। সশস্ত্র বাহিনীরও সেই আশা ও অপেক্ষা, যা নিয়ে তিন বাহিনীর প্রধানদের বিশদ কথা হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে। সেনা ব্রিংফিংয়ে ক্লিয়ার করা হয়েছে আরো অনেক কিছু। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী যোগ করেছেন আরেকটি দামি কথা। নির্বাচনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু ফ্যাক্টর রয়েছে জানিয়ে বলেছেন, মূল ফ্যাক্টর হচ্ছে জনগণ। তারা নির্বাচনমুখী হয়ে গেলে অনেকে অনেক কিছু করার চেষ্টা করলেও পারবে না। সত্যিই এই ‘অনেকরা’ আরো ‘অনেক’ কিছু করার চেষ্টা সেই জুলাই-আগস্টেও করেছে। পারেনি ছাত্র-জনতা আর সেনাবাহিনীর একমুখী অবস্থানের কারণে।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট, ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।
BBS cable ad

সেনাবাহিনী এর আরও খবর: