ওসমানী বিমানবন্দরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ম্যাজিস্ট্রেটের ইউএনও হিসেবে পদায়ন
শাবিপ্রবি (সিলেট): সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনার নেপথ্যের কারিগর নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. এমদাদুল হক শরীফকে উপজেলায় নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ২৬ নভেম্বরের এক প্রজ্ঞাপনে তাকে বান্দরবানের রুমা উপজেলার ইউএনও হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
ওসমানী বিমানবন্দর—প্রবাসী যাত্রী প্রবাহের অন্যতম প্রধান এই টার্মিনাল—দীর্ঘদিন ধরেই যাত্রী হয়রানি, চুরি-চক্র, অবৈধ পার্কিং, অতিরিক্ত ফি আদায়, ভিক্ষুকদের দৌরাত্ম্যসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিল। তবে চলতি বছরের মে মাসে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এমদাদুল হক শরীফ দায়িত্ব নেওয়ার পর ধারাবাহিক অভিযানে দৃশ্যমান পরিবর্তন আসে। যাত্রীসেবার মানোন্নয়ন, হয়রানি প্রতিরোধ ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার এসব উদ্যোগ ইতোমধ্যে যাত্রীদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। বিমানবন্দর সূত্রে তার নেতৃত্বে পরিচালিত উল্লেখযোগ্য কিছু অভিযান ও উদ্যোগ নিচে তুলে ধরা হলো।
যাত্রী হয়রানি প্রতিরোধে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট
গত তিন মাসে বিমানবন্দরে ৭০টিরও বেশি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়। যাত্রী হয়রানি, অবৈধ পার্কিং, পোস্টার-স্টিকার লাগানো, ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে হয়রানি, নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে অসদাচরণ এবং এয়ারলাইন্সের সেবা ব্যত্যয়সহ বিভিন্ন অভিযোগে মামলা করা হয়।
বিমানবন্দরের সাতটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অভিযোগ গ্রহণের জন্য স্ট্যান্ডবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে। যাত্রীরা ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ বা ই-মেইলের মাধ্যমে সরাসরি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে অভিযোগ জানাতে পারছেন। এতে অভিযোগ গ্রহণ ও ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া আরও দ্রুত ও কার্যকর হয়েছে।
লোডার চক্র নির্মূলে স্বস্তি
দীর্ঘদিন ধরে ৪০–৫০ জনের একটি লোডার চক্র লাগেজ ট্রলি নিয়ে যাত্রীদের পিছু নিত এবং গাড়িতে লাগেজ তোলার পর জোরপূর্বক টাকা আদায় করত। ধারাবাহিক অভিযানে অন্তত ১০ জনকে এক থেকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে চক্রটি নির্মূল হওয়ায় যাত্রীরা নির্ভয়ে নিজস্ব লাগেজ নিজেরাই বহন করতে পারছেন। অভিযোগও প্রায় শূন্যে নেমে এসেছে।
ভিক্ষুকদের দৌরাত্ম্যের অবসান
‘এক্সকিউজ মি স্যার, আই’ম হাংরি—গিভ মি টেন পাউন্ড!’—এমন ঘটনা বিমানবন্দরে প্রায় নিয়মিত ছিল। তদন্তে দেখা যায়, অনেক ভিক্ষুকই আর্থিকভাবে স্বচ্ছল, কেউ কেউ আবার ভিক্ষুকদের ইংরেজি শেখাতো পর্যন্ত। নিয়মিত মোবাইল কোর্ট ও কঠোর নজরদারিতে ভিক্ষুকদের স্থানীয় প্রতিনিধিদের জিম্মায় হস্তান্তর করা হয়। বর্তমানে বিমানবন্দর এলাকা ভিক্ষুকমুক্ত।
অবৈধ পার্কিং নিয়ন্ত্রণ
ক্যানোপি ও কার পার্কিং এলাকায় নো-পার্কিং জোনে গাড়ি রেখে চলাচলে বিঘ্ন ঘটানো দীর্ঘদিনের সমস্যা ছিল। গত তিন মাসে ৫০ জনের বেশি চালককে জরিমানা করা হয়েছে। ফলে নো-পার্কিং এলাকায় গাড়ি না থাকায় যাত্রী চলাচল নির্বিঘ্ন হয়েছে এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি কমেছে।
টয়লেটে অতিরিক্ত ফি আদায়: ইজারাদারকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা
নির্ধারিত ৫ টাকার পরিবর্তে ১০ টাকা ফি আদায়ের অভিযোগে ইজারাদারকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। একই সঙ্গে ফি সংশোধন করে নতুন নোটিশ ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।
যাত্রীছাউনিতে পোস্টার উচ্ছেদে ২০ হাজার টাকা জরিমানা
যাত্রীছাউনিতে পোস্টার ও স্টিকার লাগিয়ে টার্মিনালের সৌন্দর্য নষ্ট করার দায়ে দোষীদের ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় এবং তাৎক্ষণিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা হয়।
আরও উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ
বিমানের যাত্রী মনিটর ভাঙায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পক্ষে ১১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ আদায়—যা দেশের বিমানবন্দর ইতিহাসে বিরল ঘটনা।
ফ্লাইটে কেবিন ক্রুকে উত্ত্যক্ত করার ঘটনায় এক যাত্রীকে ১ লাখ টাকা জরিমানা।
আনসার, এপিবিএন ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কর্মীদের দায়িত্বপালনে বাধা দিলে কঠোর ব্যবস্থা।
ঢাকা বিমানবন্দরে আগুনের ঘটনায় সিলেটে জরুরি অবতরণ করা যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত মূল্য নেওয়ায় এক দোকানিকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা।
দীর্ঘদিন ধরে বকেয়া থাকা বিমানবন্দরের একটি সেবা সংস্থার কর্মীদের ন্যায্য বেতন নিশ্চিত করা।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এমদাদুল হক শরীফের এসব পদক্ষেপে বিমানবন্দরে আমূল পরিবর্তন এসেছে। অনিয়ম ও অপরাধ দমনে তার জিরো টলারেন্স নীতি ব্যাপক প্রশংসিত হচ্ছে। যাত্রীরা বলছেন, আগের তুলনায় হয়রানি অনেক কমেছে, শৃঙ্খলা বেড়েছে এবং সেবার মান দৃশ্যমানভাবে উন্নত হয়েছে। বিদেশফেরত প্রবাসী থেকে শুরু করে অভ্যন্তরীণ রুটের যাত্রী—সবাইই পরিবর্তন অনুভব করছেন।
ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চলমান এসব উদ্যোগ শুধু যাত্রীসেবা উন্নয়নেই নয়, বরং একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন বিমানবন্দরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ও বাড়িয়েছে। ভবিষ্যতে বিমানবন্দরের দায়িত্বে যিনিই আসবেন, এ ধারাবাহিকতা বজায় রাখবেন—এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. এমদাদুল হক শরীফ।


