নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩১,আশঙ্কাজনক অনেকে

রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৩১-এ দাঁড়িয়েছে। এ ঘটনায় আহত ১৬৫ জন বলে জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)। আহতদের বেশ কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসা নেয়াদের মধ্যে ৩০ জন এখনো ঝুঁকিমুক্ত নয় বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। ফলে নিহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে।
এদিকে নিহতের সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আহত ও দগ্ধ রোগীদের দেখতে গত সোমবার হাসপাতালে গিয়েছিলেন তিনি। রংপুর সদরের মমিনপুর স্কুলমাঠে গতকাল বিকালে এক সংক্ষিপ্ত সমাবেশে জামায়াত আমির বলেন, ‘আমাদের ধারণা, শতাধিক লোক মারা গেছে।’
আইএসপিআরের দেয়া সর্বশেষ পরিসংখ্যানে দেখা যায়, যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় মোট ১০টি হাসপাতালে আহত ১৬৫ জন ভর্তি রয়েছে। আর যারা প্রাণ হারিয়েছে তাদের মধ্যে কয়েকজন ছাড়া সবাই স্কুলের খুদে শিক্ষার্থী।
lddd
নিহতদের জন্য উত্তরায় কবরস্থান ঠিক করে দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর জানায়, মাইলস্টোন স্কুলের অদূরে উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের সিটি করপোরেশন কবরস্থানে নিহতদের দাফন করা যাবে। পরে এ কবরস্থান তাদের স্মৃতি রক্ষায় সংরক্ষণ করা হবে।
এদিকে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় হতাহতের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশসহ ছয় দফা দাবিতে দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত ও আহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ, হতাহত শিক্ষার্থীদের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ, শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক সিআর আবরারের পদত্যাগ, শিক্ষা সচিব সিদ্দিক জোবায়েরকে দায়িত্ব থেকে অপসারণ, বিমান বাহিনীর ব্যবহৃত ঝুঁকিপূর্ণ ও পুরনো প্রশিক্ষণ বিমান বাতিল করে আধুনিক ও নিরাপদ বিমান চালু করা ইত্যাদি। এরই মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব সিদ্দিক জোবায়েরকে প্রত্যাহার করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। বাকি দাবিগুলোও মেনে নেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে।
নিহতের সংখ্যা নিয়ে নানা মহলের আপত্তির বিষয়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, বিভ্রান্তি নিরসন হতে আরো সময় লাগবে। বার্ন ইউনিটে ভর্তি রোগীদের মধ্যে দুজনকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়েছে। এছাড়া শঙ্কামুক্ত রয়েছেন আরো ১০ জন। তবে ৩০ জন এখনো ঝুঁকিতে রয়েছেন। আহতদের পর্যবেক্ষণে সিঙ্গাপুর থেকে একটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল ঢাকায় আসার কথা রয়েছে। বিভিন্ন হাসপাতালে তারা আহতদের পর্যবেক্ষণ করবে। কতজনের উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন সে সিদ্ধান্ত দেবে চিকিৎসক দলটি। তাদের পরামর্শে প্রয়োজনে আহতদের বিদেশে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে।
আহতদের চিকিৎসার জন্য ভারতও দুজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সঙ্গে নার্সের একটি ছোট দল এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম পাঠাচ্ছে বলে জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র।
এদিকে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় কোথাও কোনো ত্রুটি বা গাফিলতি পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান। ঢাকার কুর্মিটোলা বিমানঘাঁটির এ কে খন্দকার প্যারেড গ্রাউন্ডে তিনি বিমান বিধ্বস্তে নিহত ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌকির ইসলামের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আয়োজিত ফিউনারেল প্যারেডে এ কথা জানান।
বিমান বাহিনীর প্রধান বলেন, ‘এ ঘটনায় এরই মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা দ্রুততম সময়ের মধ্যে তদন্ত করে প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটন করবে। যদি কোথাও কোনো ত্রুটি বা গাফিলতি থেকে থাকে, সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
প্যারেড গ্রাউন্ডে সহকর্মী, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও পরিবারের সদস্যরা অশ্রুসিক্ত নয়নে তৌকিরকে বিদায় জানান। ফুলেল শ্রদ্ধা জানান সশস্ত্র বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় কারিগরি বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে সাতদিনের মধ্যে তদন্ত কমিটি গঠন করতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে কমিটি গঠনের ৪৫ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে বলা হয়েছে। এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি ফাহমিদা কাদের ও বিচারপতি সৈয়দ জাহেদ মনসুরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল রুলসহ কয়েকটি নির্দেশ দেন। অন্য নির্দেশনায় এ দুর্ঘটনায় আহতদের দেশে-বিদেশে সরকারি ব্যয়ে যথাযথ ও পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
একই সঙ্গে রক্তের গ্রুপ ও অভিভাবকের ফোন নম্বরসহ সব শিক্ষার্থীর জন্য পরিচয়পত্র নিশ্চিতে দ্রুত উদ্যোগ নিতেও নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। নির্দেশনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি জানিয়ে কোনো ধরনের ব্যর্থতা ছাড়াই প্রতি মাসে আদালতে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
আদেশের পর ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মুহাম্মদ শফিকুর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, কমিটির কাজ হবে ওই দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানের পাশাপাশি ত্রুটিপূর্ণ বিমান চিহ্নিত করা। তদন্তের পর যেন প্রশিক্ষণ বিমানসহ ত্রুটিপূর্ণ বিমান উড্ডয়ন নিষিদ্ধ করা যায়।
বিমান বিধ্বস্তের ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসা প্রতিবেদন যুক্ত করে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. আনিসুর রহমান রায়হান রিটটি করেন। এতে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন, ঢাকাসহ ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ত্রুটিপূর্ণ ও প্রশিক্ষণ বিমান উড্ডয়নে নিষেধাজ্ঞা, আহত ও নিহত ব্যক্তিদের পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান এবং আহত ব্যক্তিদের উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিতের নির্দেশনা চাওয়া হয়। রিটে প্রতিরক্ষা সচিব, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সচিব এবং ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালকসহ সাতজনকে বিবাদী করা হয়েছে।
আদালতে রিটের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, আইনজীবী কায়সার কামাল, গাজী কামরুল ইসলাম ও মোহাম্মদ সিদ্দিক উল্যাহ মিয়া প্রমুখ শুনানিতে অংশ নেন। রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মুহাম্মদ শফিকুর রহমান ও তানিম খান এবং সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল ইকরামুল কবির শুনানিতে ছিলেন।
আইনজীবী মো. আনিসুর রহমান রায়হান বলেন, ‘কমিটির তদন্তের পর রাজধানী ঢাকাসহ ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ত্রুটিপূর্ণ বিমান ও প্রশিক্ষণ বিমান উড্ডয়ন কেন নিষিদ্ধ করা হবে না, সে বিষয়ে রুল হয়েছে। সেই সঙ্গে বিমান বিধ্বস্তের ওই ঘটনায় নিহত প্রত্যেককে ৫ কোটি টাকা করে এবং আহত প্রত্যেককে ১ কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ দিতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, রুলে তা জানতে চাওয়া হয়েছে।’