বিশ্ব খাদ্য ফোরামে ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গঠনে ছয় দফা প্রস্তাব প্রধান উপদেষ্টার

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) সদর দপ্তরে আয়োজিত বিশ্ব খাদ্য ফোরাম ২০২৫–এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বৈশ্বিক খাদ্য ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সংস্কারের আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গঠনের লক্ষ্যে তিনি ছয় দফা প্রস্তাব পেশ করে বলেন, “ক্ষুধা কোনো অভাবের কারণে নয়— এটি আমাদের তৈরি করা অর্থনৈতিক কাঠামোর ব্যর্থতা। আমাদের এই ব্যবস্থা বদলাতে হবে।”
অধ্যাপক ইউনূসের ছয় দফা প্রস্তাব
১. যুদ্ধ বন্ধ ও সংলাপ শুরু: সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করে ক্ষুধা ও সহিংসতার দুষ্টচক্র ভাঙতে হবে।
২. এসডিজি বাস্তবায়ন ও জলবায়ু উদ্যোগ: উন্নয়ন অর্থায়নের অঙ্গীকার পূরণ করে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর টিকে থাকার সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
৩. আঞ্চলিক খাদ্য ব্যাংক: খাদ্য সরবরাহ চেইনের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে আঞ্চলিক খাদ্য ব্যাংক গঠন করা।
৪. তরুণ কৃষি উদ্যোক্তাদের সহায়তা: অর্থায়ন, অবকাঠামো ও বৈশ্বিক অংশীদারত্বের মাধ্যমে তরুণ ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সহায়তা দেওয়া।
৫. রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার: বাণিজ্যনীতিকে খাদ্য নিরাপত্তার সহায়ক করতে হবে, বাধা নয়।
৬. প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের সুযোগ: বিশেষ করে গ্লোবাল সাউথের তরুণ কৃষক ও উদ্যোক্তাদের প্রযুক্তি সুবিধা নিশ্চিত করা।
ইউনূস বলেন, “২০২৪ সালে ৬৭৩ মিলিয়ন মানুষ ক্ষুধার্ত ছিল, অথচ পর্যাপ্ত খাদ্য উৎপাদন হয়েছিল। এটি উৎপাদনের ব্যর্থতা নয়, বরং নৈতিক ব্যর্থতা।” তিনি আরও বলেন, “যেখানে ক্ষুধা দূর করতে কয়েক বিলিয়ন ডলার পাওয়া যায় না, সেখানে অস্ত্র কিনতে ব্যয় হচ্ছে ২.৭ ট্রিলিয়ন ডলার— একে কি আমরা অগ্রগতি বলব?”
অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মৌলিক সংস্কারের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, “বর্তমান মুনাফাভিত্তিক পদ্ধতি কোটি মানুষকে পিছনে ফেলে দিয়েছে। এখন দরকার সামাজিক ব্যবসা— যা ব্যক্তিগত লাভের জন্য নয়, সমাজের সমস্যা সমাধানের জন্য।”
তিনি তাঁর স্বপ্নের ‘তিন-শূন্য বিশ্ব’ ধারণা ব্যাখ্যা করে বলেন, “এটি কোনো কল্পনা নয়— এটি পৃথিবী বাঁচানোর একমাত্র পথ।”
বাংলাদেশের উদাহরণ টেনে ইউনূস বলেন, “গ্রামীণ ব্যাংক দেখিয়েছে, দরিদ্র নারীরাও উদ্যোক্তা হতে পারেন। গ্রামীণ দানোন শিশু অপুষ্টির বিরুদ্ধে লড়ছে— এটাই সামাজিক ব্যবসার শক্তি।”
তিনি বলেন, “তরুণদের চাকরি খোঁজার নয়, বরং চাকরি সৃষ্টির ক্ষমতা দিন।” তরুণ ও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সামাজিক ব্যবসা তহবিল গঠন এবং আইনগত সহায়তা দেওয়ার আহ্বান জানান ইউনূস।
“যুব সমাজের ওপর বিনিয়োগ করলে শুধু বিশ্বকে খাদ্য দেব না, বরং বিশ্বকেই বদলে দেব,” — বলেন তিনি।
বক্তৃতায় তিনি বাংলাদেশের সাফল্য তুলে ধরে বলেন, “বাংলাদেশ ১৭ কোটি মানুষের খাদ্য নিশ্চিত করছে এবং মিয়ানমারের সহিংসতা থেকে পালিয়ে আসা ১৩ লাখ রোহিঙ্গাকেও আশ্রয় দিয়েছে।”
তিনি আরও জানান
বাংলাদেশ এখন ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ
বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে ধান, সবজি ও স্বাদুপানির মাছ উৎপাদনে
কৃষি ফসলের নিবিড়তা বেড়েছে ২১৪ শতাংশে
জলবায়ু-সহনশীল ১৩৩ প্রজাতির ধান উদ্ভাবিত হয়েছে
কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ, ৭০% পর্যন্ত ভর্তুকি ও শক্তিশালী খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থা চালু হয়েছে
“আমরা কৃষিকে সবুজ করেছি— মাটি, পানি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করছি,” — বলেন প্রধান উপদেষ্টা।
এফএও’র ৮০ বছর পূর্তিতে দেওয়া বক্তৃতায় তিনি বলেন, “এই ফোরামের তিনটি স্তম্ভ— যুব, বিজ্ঞান ও বিনিয়োগ— কেবল স্লোগান নয়, এটি আমাদের খাদ্যব্যবস্থা রূপান্তরের প্রধান হাতিয়ার।”
তিনি আরও বলেন, “বিশ্বে সম্পদ ও প্রযুক্তি আছে; এখন দরকার সৃজনশীল চিন্তা ও ন্যায্য ব্যবসা কাঠামো। আমরা যদি কল্পনা করতে পারি, আমরা তা বাস্তবেও তৈরি করতে পারব।”
অধ্যাপক ইউনূস তাঁর বক্তব্যের শেষে বলেন, “আসুন, আমরা একসঙ্গে কাজ করি— একটি তিন-শূন্য বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য: শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব, শূন্য কার্বন নিঃসরণ। এটাই মানবতার ভবিষ্যতের পথ।”