বিএনপিকে রাজি করাতে বিকল্প প্রস্তাব কমিশনের

নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে (পিআর) রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন পদ্ধতিতে বিএনপিকে রাজি করাতে না পেরে বিকল্প প্রস্তাব দিতে যাচ্ছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন।
প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন এই কমিশন আজ সোমবারের সংলাপের আলোচ্যসূচি ইতোমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে পাঠিয়েছে। কমিশনের বিকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ৬৪ জেলা এবং ১২ সিটি করপোরেশন থেকে নির্বাচিত ৭৬ জনপ্রতিনিধি নিয়ে উচ্চকক্ষ গঠিত হবে। তবে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দলের নেতারা সমকালকে বলেছেন, এ প্রস্তাব অগ্রহণযোগ্য। এ নিয়ে আলোচনার কোনো সুযোগ নেই।
কমিশন প্রস্তাবে চলমান সংলাপে অংশ নেওয়া ৩০ রাজনৈতিক দল এবং জোটের মধ্যে ২৮টি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনে একমত। কমিশনের আগের প্রস্তাব অনুযায়ী, সংসদের নিম্নকক্ষ হবে ৪০০ সদস্যবিশিষ্ট। এতে বিদ্যমান ‘ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট’ (এপিটিপি) পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে। রাজনৈতিক দল মনোনীত এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে যিনি সর্বোচ্চ ভোট পাবেন, তিনি জয়ী হবেন।
এই নির্বাচনে রাজনৈতিক দল যত শতাংশ ভোট পাবে, ১০০ আসনের উচ্চকক্ষে সেই অনুপাতে আসন পাবে। জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ ২৩ দল এতে একমত। বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের মিত্র গণঅধিকার পরিষদ, গণসংহতি আন্দোলন, জেএসডি, নাগরিক ঐক্যও এতে একমত।
বিএনপি ২০২৩ সালের জুলাইয়ে ঘোষিত ৩১ দফায় উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে দলটি চায়, উচ্চকক্ষের আসন বণ্টন হবে সংসদে বিদ্যমান সংরক্ষিত নারী আসন বণ্টনের মতো। যে দল সংসদের নিম্নকক্ষে যত শতাংশ আসন পাবে, উচ্চকক্ষেও তত শতাংশ আসন পাবে। ফলে সংসদের উভয় কক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর আসন সংখ্যার শতকরা হার একই রকম থাকবে। কিন্তু কমিশন প্রস্তাব করেছে, সংবিধান সংশোধনে সংসদের উভয় কক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজন হবে। বিএনপির ভাষ্য, উচ্চকক্ষের আসন ভোটের অনুপাতে বা পিআর পদ্ধতিতে বণ্টন হলে কোনো দল এককভাবে ৬৭ শতাংশ বা দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পাবে না। ফলে ভবিষ্যতে সরকারি দলের পক্ষে একক সিদ্ধান্তে সংবিধান সংশোধনের সুযোগ থাকবে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ মনে করেন, সরকারের হাতে সংবিধান সংশোধনের একক ক্ষমতা রাখতে হবে।
কমিশনের মতো জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ অন্য দলগুলোর যুক্তি, অতীতে সরকারি দল ইচ্ছামাফিক সংবিধান সংশোধন করেছে। এই ব্যবস্থা ঠেকাতেই সংসদের উচ্চকক্ষে তারা পিআর পদ্ধতি চালুর দাবি জানাচ্ছে। নয়তো উচ্চকক্ষেরই দরকার নেই। অতীতে সরকারি দলগুলো ৪০ থেকে ৪৯ শতাংশ ভোট পেয়েও দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন পেয়ে সংবিধানের যথেচ্ছ বদল করেছে। এ কারণেই ২০০৭ সালের রাজনৈতিক সংকট হয়। শেখ হাসিনা ২০১১ সালের একক যেমন ইচ্ছা সংবিধান সংশোধন করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে দলীয় সরকারের অধীনে তিনটি বিতর্কিত নির্বাচন করেন। যার ফল হিসেবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান হয়েছে।
রাজনৈতিক সূত্র সমকালকে জানিয়েছে, পিআর, উচ্চকক্ষ, সাংবিধানিক নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণসহ কয়েকটি সংস্কার প্রস্তাবে কাছাকাছি অবস্থানে আনতে গত বৃহস্পতিবার রাতে বিএনপি, জামায়াত এবং এনসিপি নেতাদের নিয়ে ‘অঘোষিত বৈঠক’ করে সরকার। তবে এতে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ বৈঠকে জানিয়ে দেন, পিআর পদ্ধতির উচ্চকক্ষ বিএনপি মানবে না। প্রয়োজন হলে উচ্চকক্ষের দরকার নেই।
জামায়াত এবং এনসিপির প্রতিনিধিরা বৈঠকে জানান, আনুপাতিক উচ্চকক্ষের দাবি তারা ছাড়বেন না। পরে সরকারের একজন উপদেষ্টা এ নিয়ে বিএনপি শীর্ষ নেতৃত্বের দ্বারস্থ হন। সেখান থেকেও জানানো হয়, সালাহউদ্দিন আহমেদের বক্তব্যই বিএনপির অবস্থান।
উচ্চকক্ষের বিকল্প প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাতে সাড়া মেলেনি। তবে সূত্র জানিয়েছে, ঐকমত্য তৈরি করতে না পেরেই বিকল্প প্রস্তাব দিচ্ছে কমিশন। প্রস্তাব অনুযায়ী, সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে উচ্চকক্ষের নির্বাচন হবে। একইভাবে জেলা এবং সিটি করপোরেশন থেকে এফপিটিপি পদ্ধতিতে একজন করে মনোনীত হবেন। তিনি রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থী হতে পারেন। পুরো জেলা বা সিটি করপোরেশনের ভোটরার ভোট দেবেন, নাকি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ভোট দেবেন, তা আলোচনায় ঠিক হবে।
তবে এ প্রস্তাবকে ‘পাগলামি’ বলেছেন জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের। বিএনপি আনুপাতিক উচ্চকক্ষে রাজি না হলেও জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল সংসদ নির্বাচনও পিআর পদ্ধতিতেই চাচ্ছে। ডা. তাহের বলেছেন, পিআর প্রশ্নে কোনো ছাড় নেই। জেলা, সিটি করপোরেশন থেকে নির্বাচনের প্রস্তাব আসে কোথা থেকে?
সংলাপে এনসিপির প্রতিনিধিত্ব করা দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক জাভেদ রাসিন বলেন, আনুপাতিক পদ্ধতির উচ্চকক্ষ এবং সাংবিধানিক নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ– এ দুটিই মৌলিক সংস্কার। এ থেকে এনসিপি সরবে না।